স্পিরুলিনার স্বাস্থ্য উপকারিতা
বিশেষজ্ঞদের মতে স্পিরুলিনা খুবই উপকারি একটি খাদ্য। আমাদের পৃথিবীতে হাজার হাজার বিভিন্ন ধরণের শৈবাল রয়েছে। তবে তিনটি এখন পর্যন্ত সর্বাধিক জনপ্রিয়। স্পিরুলিনা (সেই সবগুলি নীল বর্ণের মধ্যে মূল উপাদান), এএফএ এবং ক্লোরেলা। মূলত এই তিনটি জনপ্রিয় শৈবালের মধ্যে প্রোটিন, আয়রন, পটাসিয়াম, দস্তা, ক্যালসিয়াম এবং বি ভিটামিন সহ পুষ্টি এবং ভিটামিনগুলির খুব বেশি পরিমাণে রয়েছে।
সুপারফুড স্পিরুলিনা (Spirulina) এর স্বাস্থ্য উপকারিতা – জাহাঙ্গীর কবির (Dr. Jahangir kabir)
দুর্দান্ত পুষ্টি উপকরণ সমৃদ্ধ স্পিরুলিনা উপকারিতা হ’ল স্পিরুলিনা সেবনের পরে উল্লেখযোগ্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই মানুষের ডায়েটে প্রোটিন এবং ভিটামিন সরবরাহ করার এক উপায়।
সুপারফুড স্পিরুলিনা এর স্বাস্থ্য উপকারিতা । Spirulina | পুষ্টিবিদ আয়শা সিদ্দিকা (Dr. Aysha Siddika)
এক টেবিল চামচ স্পিরুলিনা বা শুকনো স্পিরুলিনার (৭ গ্রাম) উপকারিতা
১) ২০ ক্যালোর
২) প্রোটিনের ৪.০২ গ্রাম
৩) ১.৬৭ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট
৪) ০.৫৪ গ্রাম ফ্যাট
৫) ৮ মিলিগ্রাম (মিলিগ্রাম) ক্যালসিয়াম
৬) ২ মিলিগ্রাম আয়রন
৭) ১৪ মিলিগ্রাম ম্যাগনেসিয়াম
8) ফসফরাস ৮ মিলিগ্রাম
৯) পটাসিয়াম ৯৫ মিলিগ্রাম
১০) ৭৩ মিলিগ্রাম সোডিয়াম
১১)ভিটামিন সি এর ০.৭ মিলিগ্রাম
এছাড়াও স্পিরুলিনাতে থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ফোলেট এবং ভিটামিন বি -6, এ, এবং কে.টেকিং রয়েছে, সুষম ডায়েটের অংশ হিসাবে, কোনও ব্যক্তিকে ভাল পুষ্ট রাখতে সহায়তা করতে পারে।
ওজন হ্রাসে স্পিরুলিনা
সাধারণত ওজন হ্রাস করতে প্রতিদিন যতটুকু ক্যালরি গ্রহণ করা হয় তার চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়। স্পিরুলিনা একটি উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ, কম ক্যালোরিযুক্ত খাবার যা কিনা স্বল্প পরিমাণে গুঁড়োতে প্রচুর পুষ্টিউপাদান সমৃদ্ধ থাকে। ডায়েটে স্পিরুলিনা রাখলে কোনো পুষ্টির অভাব ছাড়াই ওজন হ্রাস করতে সহায়তা করে।
২০১৬ সালের ডাবল-ব্লাইন্ড প্লাসেবো-নিয়ন্ত্রিত একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, স্পিরুলিনা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ৩ মাস ধরে অতিরিক্ত ওজনযুক্ত এবং নিয়মিত স্পিরুলিনা খেয়েছিলেন তারা বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআইতে উন্নতি লাভ করেছেন।
অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে স্পিরুলিনা
স্পিরুলিনায় শক্ত, তন্তুযুক্ত প্রাচীর নেই এমন কাঠামোর কারণে এটি সহজে হজমযোগ্য। কিন্তু এটি সেবনে কি অন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা উন্নতি হতে পারে?
মানবসম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে আরও গবেষণার প্রয়োজন, তবে অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রে স্পিরুলিনা অন্ত্রের জন্যে দারুণ উপকারি। ইঁদুরের উপর ২০১৭ তে চালানো একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, স্পিরুলিনা বার্ধক্য প্রক্রিয়া চলাকালীন অন্ত্রের উপকারি ব্যাকটেরিয়া সংরক্ষণ করতে পারে।
স্পিরুলিনায় খুব বেশি ফাইবার থাকে না, তাই খাদ্যতালিকায় অন্ত্রের জন্যে স্বাস্থ্যকর, উচ্চ ফাইবারযুক্ত অন্যান্য খাবার অন্তর্ভুক্ত করা অপরিহার্য।
আরও পড়ুনঃ বাড়িতেই করুন দারুচিনি চাষ
স্পিরুলিনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা
২০১৮ এর একটি পর্যালোচনা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, স্পিরুলিনা ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ স্তরকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। ডায়াবেটিস টাইপ ১ এবং ২ সহ লোকেদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ রক্ত শর্করার একটি সাধারণ সমস্যা এটি সুপারিশ করে যে স্পিরুলিনা মানুষের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
এই ফলাফলগুলি থেকে বোঝা যায় যে স্পিরুলিনা টাইপ ২ ডায়াবেটিস পরিচালনার জন্য খাদ্য হিসাবে প্রতিশ্রুতি দেখায়।
২০১৭ সালে পরিচালিত প্রাণীদের নিয়ে একটি গবেষনায় এই ধারণাটিকে সমর্থন করে যে স্পিরুলিনা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই গবেষণায় গবেষকরা টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ইঁদুরদের স্পিরুলিনা সাপ্লিমেন্ট মুখ দিয়ে পুশ করা হয়। ফলস্বরূপ, ইঁদুরগুলি নিম্নলিখিত পরিবর্তনগুল দেখা দেয়ঃ
ক) রক্তে শর্করার পরিমাণ কমে
খ) উচ্চতর ইনসুলিন স্তর
গ) উন্নত লিভার এনজাইম
গবেষকরা লক্ষ করেছেন যে স্পিরুলিনার অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট প্রভাব টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিত্সায় সহায়ক হতে পারে।
কোলেস্টেরল হ্রাসে স্পিরুলিনা
স্পিরুলিনার সারাংশ গ্রহণ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সহায়তা করবে। কোলেস্টেরল হল রক্তে অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট যা বিশেষজ্ঞ চিকিতসৎসকরা হৃদরোগের একটি পরোক্ষ প্রভাবক বলে মতামত ড্যাং।
২০১৬ সালে করা একটি পদ্ধতিগত গবেষণা এবং বিশ্লেষণ থেকে জানা যায় যে স্পিরুলিনা সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ রক্তের লিপিডগুলিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে যা রক্তে চর্বি হিসেবে ভাসমান থাকে। সমীক্ষায় দেখা যায়, স্পিরুলিনা কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এবং খারাপ LDL কোলেস্টেরলকে কমিয়ে ভাল HDL বাড়ানোয় এর প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রয়েছে।
২০১৩ সালের একটি গবেষণাও এই দাবিকে সমর্থন করে। গবেষকরা দেখতে পান যে প্রতিদিন ১ গ্রাম স্পিরুলিনা গ্রহণের ফলে ৩ মাস পরে মোট কোলেস্টেরল হ্রাস পেয়েছে।
রক্তচাপ হ্রাস করা
উপরে আলোচনা থেকেই আমরা জেনেছি যে, স্পিরুলিনা কোলেস্টেরল হ্রাস করতে পারে এবং এমনও প্রমাণ রয়েছে যে এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা করে।
২০১৬ এর একটি ছোট গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৩ মাস ধরে নিয়মিত স্পিরুলিনা গ্রহণ করা ওজন ও হাইপারটেনশনে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তচাপ হ্রাস করে।
হৃদরোগ প্রতিরোধ
উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা দুটিই হৃদরোগের সাথে যুক্ত। স্পিরুলিনা যেহেতু এই উভয় ঝুঁকির কারণগুলি হ্রাস করতে পারে, এটি কি তবে হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে?
২০১৩র একটি গবেষণা থেকে জানা যায় যে, নীলাভ সবুজ শেত্তলাগুলি হৃদরোগ প্রতিরোধে ভূমিকা নিতে পারে। এটি তাদের কোলেস্টেরল-হ্রাস, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেটিভ প্রভাবগুলির কারণে হতে পারে।
স্পিরুলিনা গ্রহণে ব্যক্তির বিপাক বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে। উচ্চতর বিপাকীয় হার কোনও ব্যক্তিকে এই অনুভূতি প্রদান করে যে সে শারীরিকভাবে সবল ও সুস্থ। এটি প্রতিদিন ক্যালোরি বার্ণ করার হারও বাড়িয়ে দেয় যা ওজন হ্রাসে সহায়তা করতে পারে।
২০১৪ সালের একটি ছোট স্কেল স্টাডিতে জানা যায় যে, যারা দিনে ৬ গ্রাম স্পিরুলিনা নেন তারা বিপাকীয় প্রভাবের পাশাপাশি ওজন হ্রাসের ব্যাপারগুলি পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন।
এই গবেষণার লোকদের অ্যালকোহলবিহীন ফ্যাটি লিভারের রোগ ছিল। তাই এই শর্ত ছাড়াও স্পিরুলিনা অন্যের মধ্যে বিপাককে বাড়িয়ে তুলতে পারে কিনা তা জানতে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
স্পিরুলিনা অ্যালার্জির লক্ষণগুলি হ্রাস করে
যখন কোনও ব্যক্তির ফুলের রেণু, ধূলা বা পোষা প্রাণীতে অ্যালার্জি থাকে, তখন তাদের নাকের অভ্যন্তরভাগ ফুলে যেতে পারে। এই বিক্রিয়াকে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়। এমন কিছু প্রমাণ রয়েছে যে স্পিরুলিনা এই অবস্থার লক্ষণগুলি হ্রাসে সহায়তা করতে পারে।
২০১৩ সালের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে স্পিরুলিনা অনুনাসিক প্রদাহ উপশম করতে এবং দেহে হিস্টামিনের উৎপাদন হ্রাস করতে পারে।
২০১১ সালের একটি পর্যালোচনাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অ্যালার্জিক রাইনাইটিসে স্পিরুলিনার ইতিবাচক প্রভাবের জন্য যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ রয়েছে, তবে গবেষকরা সত্যিকারের প্রভাব সম্পর্কে জানার জন্যে আরও বড় ধরণের গবেষণা করতে চান।
অ্যান্টিটক্সিক ক্রিয়া
বিশ্বের কিছু অংশে, মানুষ দূষিত পানীয় জল এবং দূষণকারী অন্যান্য উৎস থেকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রাথমিক গবেষণা পরামর্শ দিয়েছে যে, স্পিরুলিনা শৈবালটি আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য নতুন সম্ভাবনা হতে পারে।
পরে ২০১৬ সালের একটি পর্যালোচনাতে দেখা গেছে যে স্পিরুলিনায় অ্যান্টিটোক্সিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা শরীরে দূষণকারীদের প্রতিরোধ করতে পারে, যেমনঃ
১) আর্সেনিক
২) ফ্লোরাইড
৩) লোহা
৪) লেড
৫) পারদ
পর্যালোচনার গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন যে স্পিরুলিনা দূষণকারী বিষের ক্লিনিকাল চিকিত্সার জন্য দরকারী খাদ্য সাপ্লিমেন্ট হতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে
২০১৮ এর একটি গবেষণাপত্র মুড ডিসঅর্ডার এর চিকিৎসা করতে স্পিরুলিনা যে ভূমিকা নিতে পারে তা তুলে ধরে হয়l
তত্ত্বটি হল স্পিরুলিনা ট্রিপটোফেনের উৎস। ট্রিপটোফেন একটি অ্যামিনো অ্যাসিড যা সেরোটোনিন উৎপাদনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সেরোটোনিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানসিক চাপ এবং উদ্বেগের মতো কিছু মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেরোটোনিনের মাত্রা কম থাকে। স্বাস্থ্যকর সেরোটোনিন মাত্রা বজায় রাখতে ট্রিপটোফেনের পরিপূরক গ্রহণ করা মানসিকভাবে সুস্থতায় সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্যকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে স্পিরুলিনার আসল ভূমিকা জানার আগে গবেষকদের আরও ক্লিনিকাল গবেষণা করা দরকার।
মিথস্ক্রিয়া বা ঝুঁকি আছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) স্পিরুলিনার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে না, তবে ২০১৪ সালের পর্যালোচনাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে স্পিরুলিনা বেশিরভাগ মানুষের নিকট সহনীয়, তাই কোনও উল্লেখযোগ্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।
স্পিরুলিনা সহ নতুন ডায়েটরি পরিপূরক গ্রহণের আগে কোনও ডাক্তারের থেকে অবশ্যই পরামর্শ নেওয়া উচিত।
ট্যাবলেট
স্পিরুলিনা ট্যাবলেট
ডায়েটে কীভাবে স্পিরুলিনা অন্তর্ভুক্ত করা যায়?
স্পিরুলিনা পাউডার বা ট্যাবলেট আকারে পাওয়া যায়।
পাউডার হিসাবেঃ
ক) এটি স্মুদিতে যুক্ত করতে পারেন, যা আপনার পানীয়কে সবুজ করবে
খ) সালাদ বা স্যুপে স্পিরুলিনা ছিটিয়ে দিতে পারেন
গ) এটি অন্যান্য স্বাস্থ্যকর উপাদানগুলির সাথে মিশ্রিত করতে পারেন
ঘ) ফল বা উদ্ভিজ্জ রসের সাথে এক টেবিল চামচ স্পিরুলিনা নাড়ুন
ঙ) ট্যাবলেট আকারে ডায়েটরি পরিপূরক হিসাবে স্পিরুলিনা নিতে পারেন।
দেশীয় বিভিন্ন হেলথ ফুড স্টোর বা অনলাইন স্টোর থেকে শুকনো স্পিরুলিনা কিনতে পারেন। স্পিরুলিনা ট্যাবলেটগুলি স্বাস্থ্যকর খাবারের দোকান, ওষুধের দোকান এবং অনলাইনে পাওয়া যায়।
শেষ কথা
প্রাথমিক গবেষণায় স্পিরুলিনা গ্রহণের ফলে উপরোল্লিখিত উন্নতি হতে পারে।
ডাক্তাররা যে কোনও স্বাস্থ্যগত অবস্থার চিকিৎসার জন্য স্পিরুলিনার পরামর্শ দেওয়ার আগে আরও গবেষণা হওয়া দরকার।
সব রোগের মহৌষধ ‘স্পিরুলিনা’
স্পিরুলিনা অতি ক্ষুদ্র নীলাভ সবুজ শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদ। অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া দেখা যায় না। শৈবালটিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ ও একাধিক খনিজ পদার্থ রয়েছে। এটি সাধারণত পানিতে জন্মে। ১-৩ গ্রাম স্পিরুলিনায় রয়েছে ১-৩ কেজি বিভিন্ন ধরনের সবজির গুণাবলি।
বিসিএসআইআর’র বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ডিভিশন সূত্রে জানা যায়, বর্তমান বাজারে স্পিরুলিনা ট্যাবলেট, ক্যাপসুল ও পাউডার এবং ফ্লেক্স হিসেবে পাওয়া যায়। বর্তমানে স্পিরুলিনাযুক্ত পাউরুটি ও পানীয় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।
কেন খাবেন স্পিরুলিনা:
সবার আগে বলে নিই এটা একটা ফুড সাপ্লিমেন্ট, কোন ঔষধ নয়। প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ ও নীলাভ সবুজ রঙ থাকার কারণে স্পিরুলিনায় রয়েছে নানা ধরনের রোগ দমনের ক্ষমতা। তাই স্পিরুলিনা একটি ভেষজগুণসম্পন্ন শৈবাল। স্বাদ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন স্পিরুলিনা নিয়মিত খেলে আমাদের দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণ করবে, পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা, রাতকানা, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, আলসার, বাত, হেপাটাইটিস ও ক্লান্তি দূর করে। আপনি জেনে অবাক হবেন, বিশ্বে প্রতি বছর ২২০০ টন স্পিরুলিনা খাওয়া হয়ে থাকে এবং জাপানেই প্রতিবছর স্পিরুলিনা খাওয়া হয় ৫০০ টন। একটি গবেষনায় দেখা গেছে, জাপানিজদের গড় আযূ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী হওয়ার অন্যতম কারন হচ্ছে স্পিরুলিনা।
বিশ্বের বড় বড় সব আর্গানাইজেশন স্পিরুলিনাকে যে স্বীকৃতি দিয়েছে তা হল:
* প্রতি কেজি স্পিরুলিনা ১০০০ কেজি মিশ্র ফল ও সবজীর সমতুল্য – NASA
* স্পিরুলিনা মানবজাতির জন্য প্রোটিনের শ্রেষ্ট উৎস – FDA
* স্পিরুলিনা ভবিষ্যতের শ্রেষ্ঠ খাদ্য – United Nation
* স্পিরুলিনা আগামীর জন্য আদর্শ ও নিখুঁত খাদ্য – UNESCO
* স্পিরুলিনা ২১ শতকের মানব সম্প্রদায়ের জন্য শ্রেষ্ঠ স্বাস্থকরী খাদ্য – WHO
* আমরা বিশ্বের অপুষ্টির প্রতিকার হিসেবে স্পিরুলিনা সুপারিশ করছি -IIMSAM P2
কি কি রোগে উপকারী:
১) এতে শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট আছে, যা ক্যান্সার রোধ করতে খুবই সাহায়ক;
২) স্পিরুলিনা ওজন কমায়। মাসিকের সময়ের ব্যথা দূর করে।
৩) স্পিরুলিনা টোটাল কোলেস্টেরল, খারাপ কোলেস্টেরল (এলডিএল), ট্রাইগ্লিসারাইড এর মাত্রা কমায়, পাশাপাশি ভাল কোলেস্টরল (এইচডিএল) এর মাত্রা কমিয়ে দিয়ে হার্ট অ্যাটাকের শংকা থেকে রক্ষা করে।
৪) এটি সব ধরনের ভাইরাসের শক্তি খর্ব করে।
৫) স্পিরুলিনা উচ্চ রক্তচাপ কমায়, স্ট্রোকের ঝুকিঁও এটি কমায়।
৬) স্পিরুলিনা প্রধান একটা গুণ হল এটি অ্যালার্জির একটি মহৌষধ।
৭) স্পিরুলিনার আরও একটি চমৎকার গুণ হলো এটি এনিমিয়া (রক্তশূন্যতা)-র উপর খুবই এফেকটিভ। কারণ এতে প্রচুর পরিমানে আয়রণ থাকে।
৮) পেশী শক্তিশালী করে।
৯) স্পিরুলিনা উল্লেখযোগ্যভাবে রক্তে শর্করার মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এটি টাইপ ২ ডায়াবেটিস ৮%- ৯% কমিয়ে দিতে পারে।
১০) আমাদের খাবার বা ঔষধে অনেক রকম ভারি ধাতব প্রদার্থ থাকে যাতে কিডনির উপর ক্ষতিকর প্রভাব পরে। ম্যাকলিনা (স্পিরুলিনা) এ আছে প্রচুর পরিমানে ক্লোরোফিল যা রক্তকে পরিস্কার করে শরীরকে এসব ভারী ধাতব প্রদার্ত ও অপ্রয়োজনিয় বর্জ্যকে বের করে দেয় এবং কিডনিকে সুস্থ্য ও স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে ।
১১) প্রোটিনের প্রধান উৎস। গরুর গোস্তের সাথে তুলনা করলে, এতে ৬৫-৭১ ভাগ পূর্ণ মাত্রায় প্রোটিন আছে। যেখানে গরুর গোস্তে আছে ২২ ভাগ।
১২) স্পিরুলিনা লিভারের ক্ষতি এবং সিরোসিস এর বিরুদ্ধে কাজ করে শরীরকে রক্ষা করে। লিভারের ব্যথা হ্রাস করে এবং লিভারে ট্রাইগ্লিসেরাইড এর ক্ষতি এড়িয়ে যেতে সক্ষম।
১৩) ই.কোলাই এবং চান্দিদার মত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি দমন করে । স্পিরুলিনা পাচনতন্ত্রএর মধ্যে lactobacillus এবং bifidobacteria মত ভাল ব্যাকটেরিয়া তৈরী করে। সুতরাং, এটা পুষ্টি শোষণ করে শরীরের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে হজম বাড়ায়।
১৪) স্পিরুলিনা আর্সেনিক নিরাময় করে। প্রতিদিন ১০ গ্রাম করে স্পিরুলিনা খাওয়ালে প্রায় ৪ মাস পর রোগী সম্পূর্ণরূপে সুস্থ্য হয়ে উঠে। যেহেতু এখন পর্যন্ত আর্সেনিক রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি সে ক্ষেত্রে স্পিরুলিনা সেবন করে আর্সেনিকমুক্ত থাকাটা সত্যিই আমাদের জন্য বিরল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
১৫) দীর্ঘদিন সেবন করলে যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। দীর্ঘদিন সেবন করলে চোখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয় এবং দৃষ্টিশক্তি সঠিক মাপে আনতে সাহায্য করে।
১৬) এটি শরীরের মধ্যকার খারাপ পদার্থ বের করে দেয়ার ক্ষমতা রাখে।
১৭) স্মৃতি শক্তি ও একাডেমিক পারফর্মমেন্স উন্নত করে। যেহেতু, স্পিরুলিনাতে প্রচুর পরিমান ভিটামিন বি-১২ আছে, যা মেধা বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৮) স্পিরুলিনাতে প্রচুর পরিমান এমিনো এসিড, সিসটেইন ও উচ্চমান সম্পন্ন প্রোটিন থাকায় এটা গ্যস্টিক ও ডিওডেনাল আলসার কিউর করে।
কি আছে এই স্পিরুলিনায়:
১. গরুর কলিজি থেকে ৪ গুণ বেশি আয়রন।
২. গাঁজর থেকে ৩৯ গুণ বেশি বিটা ক্যরোটিন।
৩. দুধের থেকে ২৬ গুণ বেশি ক্যালশিয়াম।
৪. প্রোটিন আছে ডিমের ৬ গুণ।
৫. ক্লোরোফিল আছে আলফাফা এবং গমের ঘাস থেকে ৫-৩০ গুণ।
৬. ১৮টি এমিনো এসিড।
৭. বিভিন্ন ধরণের ৯৬টি উপাদান।
বাংলাদেশে গবেষণা:
ফ্রান্সের আর্থিক সহযোগিতায় ঢাকার বিসিএসআইআর গবেষণাগারে ফ্রান্সের বেক্মা পদ্ধতিতে স্পিরুলিনার চাষ শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা দেশের আবহাওয়া ও অর্থনৈতিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে স্পিরুলিনা চাষের কিছু পরিবর্তন করেন। বাংলাদেশে প্রথম বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ক্ষুদ্র শৈবাল স্পিরুলিনা চাষের শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। বিসিএসআইআর’র কাছ থেকে পদ্ধতিটি ইজারা নিয়ে কয়েকটি উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে স্পিরুলিনা উত্পাদন ও বাজারজাত করছে। বর্তমানে বিসিএসআইআর গবেষণাগারের অধীনে বায়োলজিক্যাল রিসার্চ ডিভিশনের বিজ্ঞানীরা স্পিরুলিনার ব্যাপক কার্যকর ভূমিকা নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
কি পরিমাণ খাওয়া প্রয়োজন?
১. পুষ্টিহীনতা প্রতিরোধে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক ১-৩ গ্রাম।
২. রক্তস্বল্পতা রোধে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক ৩-৪ গ্রাম।
৩. রাতকানা রোগ প্রতিরোধে ১-৬ বছরের শিশুদের জন্য দৈনিক আধা গ্রাম।
৪. ৭-১১ বছরের শিশুদের জন্য দৈনিক ১ গ্রাম।
৫. ১২ বছরের ঊর্ধ্বে দৈনিক ১ থেকে দেড় গ্রাম।
৬. ডায়াবেটিসে প্রতিদিন ২-৩ গ্রাম।
৭. বাত, আলসার, হেপাটাইটিস, উচ্চরক্তচাপ কমাতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দৈনিক ৩-৪ গ্রাম।
৮. স্থূলতা প্রতিরোধে প্রতিদিন ৩ গ্রাম স্পিরুলিনার গুঁড়া প্রতিবেলার খাবারের আধঘণ্টা আগে খেতে হবে।
তবে স্বাভাবিজ ডোজ হল: ৩ থেকে ৫ গ্রাম দৈনিক। এই মাত্রাকে ভাগ করে দিনে ২ থেকে ৩ বার নিতে হবে। স্পিরুলিনা খাওয়ার সময় পর্যপ্ত পরিমান পানি খেতে যাতে তা তাড়াতাড়ি শোষিত হয়।
সতর্কতা:
শুকনা ও পরিষ্কার পাত্রে স্পিরুলিনা রাখতে হবে। বাতাস বা পানির সংস্পর্শে শুকনা স্পিরুলিনা খাওয়া যাবে না। বেশি মাত্রায় লৌহ ও ভিটামিনের কারণে ব্যবহারকারীর স্পিরুলিনা সহ্য না হলে স্পিরুলিনা খাওয়ার মাত্রা বা পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
স্পিরুলিনা খাওয়া আরম্ভ করলে প্রথম কয়েকদিন পেটে একটু ভুটভাট করতে পারে। নিরুৎসাহী না হয়ে খাওয়া চালিয়ে গেলে পরবর্তীতে এই সমস্যা থাকবে না।
বিদ্র: বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর স্পিরুলিনা পাওয়া যায়। তাই কেনার আগে ভাল এবং মানসম্মত কোম্পানীর স্পিরুলিনা কেনা উচিত।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যারা উৎপাদন করছে :
এভারগ্রিন এন্টারপ্রাইজ, সাভার, লাইফ লাইন ইন্টারন্যাশনাল (প্রজেক্ট বিল্ডার্স লিঃ), লাঙ্গলবন্দ, সোনাগাঁও, নেচার ফুড প্রোডাক্টস, ধামরাই, ওয়ান্ডার হার্বস, নয়াপুর, সোনারগাঁও, ইউরেকা ইন্টারন্যাশনাল, ধউর, উত্তরা, গ্রিনটেক গ্রিনহাউস বাংলাদেশ লি.।
যেখানে পাওয়া যাবে:
১. লাজ ফার্মা : কলাবাগান, ঢাকা।
২. সিভিক পয়েন্ট : সায়েন্স ল্যাবরেটরি পুলিশ বক্স সংলগ্ন, মিরপুর রোড।
৩. নেচার ফুড প্রোডাক্টস : স্পেকট্রাম ইন্টারন্যাশনাল, নোয়াব ম্যানশন (২য় তলা), ৩৪ গ্রিন রোড, ধানমন্ডি।
৪. লাইফ লাইন ইন্টারন্যাশনাল : বিক্রয় কেন্দ্র, ৬৯২/ বি, বড় মগবাজার।
তথ্যসূত্র:
(১)স্পিরুলিনা
(২) স্পিরুলিনা’র স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী দিকসমূহ
(৩) ‘সুপারফুড’ স্পিরুলিনা বাড়ির ছাদেই হবে
(৪) স্পিরুলিনা ভালো না খারাপ?